বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এর কৃষিখাত ও কৃষকের বর্তমান পরিস্থিতি একই সঙ্গে দুঃখজনক এবং চিন্তনীয় বিষয়। কৃষিখাতে এদেশের অপার সম্ভাবনা থাকলেও বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যোগ্য ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অভাবে এ খাতটি চরম দুর্নীতির মধ্য দিয়ে গেছে। আর তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আমদানিনির্ভর কৃষিখাত, কৃষকদের কৃষিঋণের দুষ্টচক্রে আটকে ফেলাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে এদেশের কৃষিব্যবসা।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নিত্যকার পরিধিতেই থাকে। আর আগামীর বাংলাদেশ এবং এর সম্ভাবনা নিয়ে এদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেমনটা মনে করেন তা জানার আগ্রহ বরাবরই। গত ৯ নভেম্বর ২০২৪ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল আয়োজিত ৩ মাসব্যাপী প্রান্তিক কৃষি ও কৃষকভিত্তিক একটি কর্মসূচির উদ্বোধন করে প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছেন তারেক রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে শুনলাম ওনার সম্পূর্ণ বক্তব্য; যেখানে দেশের কৃষক ও কৃষিখাতকে বাঁচাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা শুধু সময়োপযোগীই নয় বরং বিশদ আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে পালনযোগ্যও বটে।
দেশনায়ক তারেক রহমানের ভাষ্যমতে, প্রায় ২০ কোটি বাংলাদেশিদের অধিকাংশ এই কৃষিখাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই, ২০২৩ সালে বিএনপি প্রণীত রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা ৩১দফায় কৃষিবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে এবং অবহেলায় জর্জরিত এদেশের কৃষিখাতকে ‘কৃষিশিল্প’-তে উন্নীত করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের কাছে পৌঁছে তাদের সমস্যা জানার উপর জোর দিয়েছেন তিনি।
তার কৃষিভাবনা এমন কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে উল্লেখ করতে গিয়েই প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান ও খান মো. মনোয়ারুল ইসলাম ‘তারেক রহমান: পরম্পরার নিশানটি যার হাতে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন: ‘ঠিক জিয়ার মতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের সার, কীটনাশক গবাদিপশু বিতরণ করেছেন…’ বাংলাদেশের কৃষিশিল্পের উন্নয়নের জন্য যে সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে ফসলের বীজ সমস্যার কথা সর্বপ্রথমে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সার ব্যবসায় ডিলারের অপ্রতুলতা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের কৃষিশ্রমিকদের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে যাওয়া, কৃষিজমির পরিমাণ কমে দেশে খাদ্য উৎপাদন সংকট ও তার ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সেচ সমস্যা, সঠিকভাবে পানি ব্যবহারে প্রশিক্ষণের অভাবের মতো বাস্তবসম্মত কিছু সমস্যাকে নির্দেশ করেছেন।
এছাড়াও, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি, যেখানে কৃষি জমির অপ্রতুলতা ও খাদ্য উৎপাদনে সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমার কারণে প্রায় ২০ কোটির মতো এত বিশাল একটা জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে সংকট দেখা দিচ্ছে। যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমদানিনির্ভর কৃষি ব্যবসা গড়ে উঠেছে। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবসাও দিনদিন বেড়ে চলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
কৃষিকাজে পানির অপ্রতুলতা, খাল খনন কর্মসূচিকে সঠিকভাবে পরিচালনা না করার ফলে বন্যায় জনজীবন ও কৃষিজ সম্পদসহ অন্যান্য জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে সেচের পানির সুষ্ঠু ব্যবহারে অজ্ঞতা -এমন আরও মৌলিক সমস্যাকে বাংলাদেশের কৃষিখাতের অন্তরায় বলে তারেক রহমান উল্লেখ করেছেন।
শুধু সমস্যা চিহ্নিতকরণই নয় বরং তার বাস্তবসম্মত ও আধুনিক সমাধানের রূপরেখাও তারেক রহমানের কৃষিভাবনায় উঠে এসেছে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের কৃষিশ্রমিকদের জন্য তিনি ‘কৃষিবিমা’ প্রচলনের কথা বলেছেন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার জরিপ মতে, সারা পৃথিবী জুড়ে ক্ষুদ্র ও পারিবারিক কৃষকরা প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করেন এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা মহাজনদের ঋণের দুষ্টচক্রে জর্জরিত এসব কৃষকদের সহযোগিতার মাধ্যম হতে পারে এই কৃষিবীমার প্রচলন।
খাদ্যসংকট মোকাবিলা ও আমদানি নির্ভর বাণিজ্যরোধে কৃষিজমির পরিমাণ কিভাবে বাড়ানো যায়, তার বিজ্ঞানসম্মত উপায় বের করার কথা বলেছেন তিনি। পেঁয়াজ, আলু, ডিম, শাকসবজি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ অন্যান্য মৌলিক খাদ্যদ্রব্যগুলোর উৎপাদন কোথায় কিভাবে বাড়ানো যায় এবং আমদানি কমানো যায় এ বিষয়ে বাস্তব উপায় বের করার চিন্তাও তাঁর কৃষিভাবনায় উঠে এসেছে। একইসঙ্গে সরকারি বা বেসরকারিভাবে এইসব কৃষিজ পণ্য বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ করে সংগ্রহের মাধ্যমে খাদ্য সংকট সমাধানের একটি দিকও আলোচনা করেছেন।
কৃষির সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ, ফসল উৎপাদন থেকে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য চাষসহ সবখাতে কৃষকের পণ্য সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবসা করতে হবে যেন উভয়পক্ষই দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতির সূচক, তা থেকে বের হয়ে সহজ স্বাভাবিক মানসম্মত জীবনযাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে তারেক রহমান ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারিভাবে ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে ফসল ও অন্যান্য কৃষি পণ্য বিক্রয়ের ব্যবসা উল্লেখ করে কৃষিক্ষেত্রে একটি নতুন এবং বাস্তবসম্মত সম্ভাবনার দিকও নির্দেশ করেছেন।
সেচ ব্যবসার সংকট নিরসনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম কর্তৃক ১৯৭৬ সালের ০১ নভেম্বর যে খাল খনন কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন, ২০২৪ এ কৃষিজমিতে সেচের পানির অপ্রতুলতা নিরসনে খাল খনন কর্মসূচি পুনঃপ্রবর্তনের গুরুত্বও তুলে ধরেছেন তারেক রহমান।
অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি তার ‘বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবদান’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার পর দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশে খাল খনন কর্মসূচির ফলে সর্বপ্রথম ১৯৮০-৮১ সালে ধানের বাম্পার ফলন হয় এবং বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চাল রপ্তানি করতে সক্ষম হয়। সেচের পানি অপচয় রোধ করার জন্য Barret pipe line-এর সঠিক ব্যবহারের উল্লেখও তার কৃষিভাবনায় উঠে এসেছে।
এছাড়া তারেক রহমান তার কৃষিভাবনায় খাল খননের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন, যে খাল খননের মাধ্যমে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ রোধও সম্ভব এবং একইসাথে Reservoir তৈরির মাধ্যমে বন্যার পানি পরবর্তীতে কৃষিকাজে ব্যবহারও সম্ভব। একইসঙ্গে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানির ব্যবসা অপর্যাপ্ত সেখানে খাল খননের মাধ্যমে মানুষের প্রাত্যহিক কাজে পানি ব্যবহারে সুবিধা হবে এবং পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিসহ চর্মরোগের সমস্যাও দূরীভূত হবে। কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, শস্য মাড়াইয়ের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের কৃষকেদের খাস জমির বন্দোবস্ত করা, সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবসা প্রচলনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের সহযোগিতা প্রদান করা, জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতে নির্ধারিত উল্লেখযোগ্য অংশ (মোট জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ) কৃষকদের উন্নয়নে বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ব্যয় করার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিখাতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন আগামীর রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমান। বাংলাদেশের কৃষিখাতকে কৃষিশিল্পে রূপান্তর করতে সুচিন্তা প্রসূত যে রূপরেখা তিনি দিয়েছেন তা তার দূরদর্শী রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং বাংলাদেশের জন্য যোগ্য নেতৃত্বের গুরুত্বকেই নির্দেশ করে।
লেখক : এম ফিল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ।
খুলনা গেজেট/এনএম